রাবিতে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ : বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য দিবস উৎযাপন

ইপেপার / প্রিন্ট ইপেপার / প্রিন্ট
৯৮

দীন ইসলাম, রাবি প্রতিনিধি :

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ও বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। রবিবার (১০ মার্চ) সকাল ১১ টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে এ আলোচনা সভার আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. অবায়দুর রহমান প্রামানিক ও সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবীর।

- Advertisement -

রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মো. তারিকুল হাসানের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান আলোচক ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক। এতে সভাপতিত্ব করেন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবীর।

আলোচক হিসেবে অধ্যাপক মলয় কুমার ভৌমিক বলেন, ৭ই মার্চের ভাষণ অন্যতম ভাষণ হিসেবে বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলে এই ভাষণটির কথা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। একজন ব্রিটিশ গবেষক জ্যাকব এফ ফিল্ড। তিনি খ্রীস্টপূর্ব ৪৩১ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ আড়াই হাজার বছরের একটি গবেষণা তিনি তুলে ধরেছেন। এবং তার এই গবেষণামূলক গ্রন্থটির নাম হচ্ছে “We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired history” এই গ্রন্থটির ২০১ পৃষ্ঠায় “The struggle this time, the struggle for Independence ” এই শিরোনামে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এবইয়ে আরও বলা হয়েছে ১৮৬৭-১৯৭১ সাল পর্যন্ত সময়ে ইতিহাসের গতিপথ বদলে দিতে পারে এমন শীর্ষ পাঁচটি ভাষণের একটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। এবং আমরা জানি যে আরেকটি বৈশিষ্ট্য এতসব কারণেই এই ভাষণটি ওয়াল্ড ডকুমেন্টস হেরিটেজ বা বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ ভাষণটি এখন আর বাঙালির নয়, গোটা বিশ্ব মানবতার সম্পদে পরিণত হয়েছে। এই ভাষণটি একটি কালোত্তীর্ণ ভাষণ অর্থাৎ সর্বকালের , একাত্তর সালে যেমন প্রাসঙ্গিক ছিল, এখনও ততটাই আছে এবং ভবিষ্যতেও এই ভাষণটি প্রাসঙ্গিক থাকবে। এই ভাষণটি সারাবিশ্বে সর্বাধিক প্রচারিত ও শ্রবণকৃত ভাষণ। আরেকটি বৈশিষ্ট্য বলা হয় এটি একটি শ্রেষ্ঠ কুটনৈতিক ভাষণ। এই সব কথা নানা গবেষক বলেছেন। প্রথমতো আমি বলতে চাই যারা ইতিহাস চর্চা করেন সেই জায়গায় দুটি শব্দ, ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে সচরাচর ব্যাবহার করা হয়। একটা শব্দ হচ্ছে সিনক্রোনিক,আরেকটা হচ্ছে ডায়াক্রোনিক। সিনক্রোনিক শব্দটি ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এভাবে ব্যাবহার করা হয় যে হঠাৎ ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা। যে ঘটনা আগে প্রায় ঘটেইনি।অনেকেই ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণটিকে একটি সিনক্রোনিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা কাছে কখনোই মনে হয়নি এই ভাষণটি হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চে রেসকোর্স ভাষণ দিবেন এটি নির্ধারিত ছিলো। এই ভাষণ শোনার জন্য লাখো বাঙালি রেসকোর্স ময়দানে আজকের যেটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সেখানে সমবেত হবেন সেটিও অবধারিত ছিলো। এবং এই ভাষণে তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকরা কেঁপে উঠবেন, সেটিও তারা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন বলেই রেডিওতে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা এই ভাষণটির তাৎক্ষণিক সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন।যদিও পরেরদিন সকাল ৮টায় তারা এই ভাষণটি প্রচার করতে বাধ্য হওয়া। এইসব ঘটনাকে কি আমরা বলবো হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া ঘটনা? এই কথা গুলো অলিখিত হতে পারে,সেগুলোর একটা পূর্ব প্রস্তুতি আছে। এই ভাষণে যেসব কথা উল্লেখ করা হয়নি কিন্তু ইঙ্গিত করা হয়েছে, এই যে হাজার হাজার মানুষ সীমানা পেরিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে । এটি কি? উনি ভাষণ দিলেন বলেই আরেকটি দেশ গ্রহণ করলো? না এটারও প্রস্তুতি ছিলো। এক কোটি মানুষ যে আশ্রয় নিয়েছিলো ভারতে এসবি এই ভাষণের অনেক আগে থেকে পর্যায়ক্রমে, একেরপর এক প্রস্তুতির একটি নজির বলে আমরা উল্লেখ করতে পারি। এই ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে। আমরা এখানে আরও খেয়াল করবো যে,এই ভাষণটি যেটাকে আমি বললাম ইতিহাসের আরেকটি ভাষায় বলা হচ্ছে ডায়াক্রোনিক। ডায়াক্রোণিক হচ্ছে যা ইতিহাসের পরম্পরাকে একটা একই সূত্রে গেঁথে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা যে বলি বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু হাজার বছর ধরে এই অঞ্চলে যে আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছে, যেসব বিদ্রোহ হয়েছে আত্মত্যাগের ঘটনা ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর জন্মের আগেও ঘটেছে, সেই ধারাবাহিকতা। যদি ৭ই মার্চের ভাষণ দেওয়া না হতো তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসতো না।৭ই মার্চের ভাষণ এতই গুরুত্বপূর্ণ, এতই শক্তিশালী যে আমি আবারও উচ্চারণ করছি যদি ৭ই মার্চের ভাষণ দেওয়া না হতো তাহলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ৭ই মার্চ একটি ঐতিহাসিক দিবস। বঙ্গবন্ধু এই দিনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছে এজন্যই শুধু নয় এটি ঐতিহাসিক সেজন্যই যে তার এই নির্দেশে মুক্তিপ্রবল বাঙালি জাতি তাদের মুক্তির যুদ্ধের জন্য ঝাপিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল। আর এই বক্তৃতার মধ্যে তিনি অনেকগুলো দিক উল্লেখ করেছেন।প্রথমেই বাঙালিদের সকল কে স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে আমাদের নির্যাতন, হত্যা,নিপিড়ন ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরেছেন।উনি বিশ্ববাসী কে সেদিন জানিয়ে দিয়েছিলেন যে বাঙালির এই ইতিহাস রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করার ইতিহাস।বাঙালি জাতি প্রতি মূহুর্তে রক্ত দিতে হয় তাদের মুক্তির জন্য, তাদের অধিকারের জন্য। বিশ্ববাসীর মত তিনি এই বাঙালি জাতির মুক্তির পক্ষে তুলে ধরেছিলেন।তিনি সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের যে বার্তা তা সুস্পষ্ট করে প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তিনি পাকিস্তানি সে দখলদার ও সরকার কে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন যে ৭কোটি বাঙালি কে দাবায়ে রাখতে পারবেনা কারণ আমরা বাঙালিরা নিজের অধিকার আদায়ের জন্য রক্ত দিতে শিখেছি। রক্ত দিয়েছি রক্ত আরও দিবো তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এই যে সাহস, এই যে প্রত্যয় জাতীয় জীবনে প্রোথিত করেছেন এবং প্রতিটি মানুষের হৃদয় যে ঢুকাতে পেরেছেন এখানেই তার মহত্ব।সেদিন এই বক্তব্য শুনে যারা নিজ থেকে মুক্তি চাইনি তারা ব্যতিত কেউ বলতে পারবেনা যে আমার লোমকূপ থেকে লোম খাড়া হয়নি।আর এই কৃতিত্ব সে বক্তার যিনি বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, বাঙালিদের অর্থাৎ বাঙালি জাতির পিতা। মানুষ হাজারো ভাষণ দেয়,আমরা শুনি কিন্তু যে ভাষণটি মানুষের হৃদয়ে ঝাকি দেয়,মানুষের অন্তর কে অনুপ্রাণিত করে,মানুষকে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মুক্তির পথে ঝাপিয়ে পড়তে বলেছেন সেই পথে ঝাপিয়ে পড়ে ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল সেটি।তিনি বাঙালি জাতিকে চিনেছেন, বাঙালি জাতির ইচ্ছাকে চিনেছেন আর এই বাঙালি জাতিকে সসম্পূর্ণ রূপে জেনেই তিনি এই ভাষণটি দিয়েছে। ভাষনটি ছিল অলিখিত, তিনি ভাষনটি দিয়েছিলেন তার বিশ্বাস থেকে,তিনি যে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য কেদেছেন সেই কান্না,নিপীড়ন, জেল,জুলুম ও অত্যাচারের অনুভব থেকে ভাষণটি দিয়েছেন।

সমাপনী বক্তব্যে অনুষ্ঠানের সভাপতি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ৭ মার্চের যে ভাষণ ছিল সেটাকে আমরা Informal declaration of independence বলি। ৭ মার্চের বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে গেছেন। এটা পরিষ্কার এবং সত‍্য। প্রায় ১৯ মিনিটের এই ভাষণটি কোনো লিখিত ভাষণ ছিল না। ভাষণটি মূলত ছিল বঙ্গবন্ধুর আবেগ, দেশের মানুষের প্রতি ভালো লাগা, ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এখানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার কথা বলেছেন, জনগণের কী করণীয় সেটা বলেছেন। আমরা বিবেকবান মানুষ হিসেবে ব‍্যতীত হই যখন এই স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিজেই শিকার করেছেন যে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সেটা পাঠ করছেন।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন, প্রক্টর অধ্যাপক মো. আসাবুল হক, ছাত্র-উপদেষ্টা অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম সাউদ, জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক অধ্যাপক প্রদীপ কুমার পাণ্ডে, অনুষদ অধিকর্তা, ইনস্টিটিউট পরিচালক, বিভাগীয় সভাপতি, হল প্রাধ্যক্ষ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

এই বিভাগের আরও সংবাদ