সুস্বাদু অর্থকরী ফসল কাজুবাদাম

ইপেপার / প্রিন্ট ইপেপার / প্রিন্ট
২৯৮

কাজুবাদাম বিদেশি ফসল। একটা সময় ধারণা করা হতো এটি আমাদের দেশে চাষ করা সম্ভব নয়। দেশের চাহিদার পুরোটাই ছিল আমদানি নির্ভর। কিন্তু আশার কথা হচ্ছে- সৌদি খেজুর, ভিয়েতনামি নারিকেল, চায়না কমলাসহ আর দশটি বিদেশি ফলের ন্যায় এখন দেশেই চাষ হচ্ছে এই সুস্বাদু একটি অর্থকরী ফসল। শুধু চাষই হচ্ছে না বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠেছে এর প্রক্রিয়াজাত কারখানাও। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এখন এই কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকৃত কাজুবাদাম বিশ্ববাজারে রপ্তানির প্রস্তুতি চলছে। দামে চড়া তাই এটি চাষে লাভও বেশি। দেশে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি কাজুবাদাম বিক্রি হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায়। আগ্রহী পাঠক আসুন জেনে নেই কাজুবাদামের উৎপাদন প্রযুক্তি, পুষ্টিগুণ ও দেশে এটি চাষে সাম্প্রতিক সাফল্যের গল্প।

উদ্ভিদতাত্ত্বিক পরিচয় ও উৎপত্তিস্থল

- Advertisement -

কাজু গাছের বৈজ্ঞানিক নাম অহধপধৎফরঁস ড়পপরফবহঃধষব; প্রতিশব্দ অহধপধৎফরঁস পঁৎধঃবষষরভড়ষরঁস। এটি সপুষ্পক অ্যানাকার্ডিয়েসি পরিবারের বৃক্ষ। বীজ থেকে চারা তৈরি করা হয়। বেলে দো-আঁশ মাটি অথবা পাহাড়ের ঢালে ভাল জন্মে। পূর্ণবয়স্ক গাছ ১০ থেকে ১২ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। পাতা অর্ধডিম্বাকার, দেখতে কাঁঠালের পাতার মতো।

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি কাজুবাদামের ফুল ফোটার সময়। এপ্রিল থেকে জুন মাসে ফল সংগ্রহ করা হয়। কাজুবাদামের দৈর্ঘ্য ৪ থেকে ৫ সেন্টিমিটার। এর ওজন ৫ থেকে ২০ গ্রাম হয়ে থাকে। কাজুবাদামের উৎপত্তিস্থল ব্রাজিল। বর্তমানে প্রধানত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, কেনিয়া, মোজাম্বিক, তানজানিয়া, মাদাগাস্কার প্রভৃতি দেশে কাজুবাদাম উৎপাদিত হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এক সময় বাদামটির চাষ হতো না বলেই চলে। ধারণা করা হয় ১৪৯৮ সালে ভাস্কো দা গামার হাত ধরে উপমহাদেশে এন্ট্রি ঘটে কাজুবাদামের। তারপর থেকে ছড়িয়ে পড়ে এর স্বাদের সুখ্যাতি। এখন তো দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকা মহাদেশের একাধিক দেশে এই বাদামটির চাষ হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে কাজুবাদামের প্রাপ্তিস্থান

খাগড়াছড়ির পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের খেজুরবাগান, হর্টিকালচার সেন্টার, সেনানিবাস, নারানখাইয়া, পানখাইয়া পাড়া, কমলছড়ি ও জামতলী এলাকায় কাজুবাদামের গাছ চোখে পড়ে। এ ছাড়া রামগড় উপজেলার হর্টিকালচার সেন্টারেও রয়েছে কাজুবাদামের বাগান। পার্বত্য চট্টগ্রামে কাজুবাদাম চাষ সম্প্রসারণের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাঝারি আকারে কাজুবাদামের চাষ হয়েছে। অনাবাদি জমিতে পরিকল্পিতভাবে কাজুবাদাম চাষের যথেষ্ট সুযোগ আছে। ভবিষ্যতে খাগড়াছড়ির কৃষিপণ্যের মধ্যে কাজুবাদামও একটি বিশেষ স্থান করে নিতে পারে।

কাজুবাদামের বংশ বিস্তার

বীজ এবং কলম উভয় পদ্ধতিতেই কাজুবাদামের বংশ বিস্তার করা যায়। কলমের মধ্যে গুটি কলম, জোড় কলম, চোখ কলম ইত্যাদি উপায়ে কাজুবাদামের বংশ বিস্তার করা সম্ভব। একটি কাজুবাদাম গাছ ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত বাঁচে এবং ৫০-৬০ বছর পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। বীজ থেকে পলি ব্যাগে চারা তৈরি করে কিংবা কলম প্রস্তুত করে জমিতে রোপণ করতে হবে। চারা রোপণের আগে ৭-৮ মিটার দূরত্ব বজায় রেখে ১ ঘনমিটার আয়তনের গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তে সবুজ সার এবং পরিমাণমতো ইউরিয়া ও টিএসপি সার মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে ১৫ দিন পর চারা লাগাতে হবে। চারা গজালে একটি সতেজ চারা রেখে বাকি চারা তুলে ফেলতে হয়। বীজের পরিবর্তে চারা তৈরি করে নিয়েও রোপণ করা যায়। হেক্টর প্রতি প্রয়োজনীয় চারার সংখ্যা ২৪৫-৩৩৫টি।

গাছের আন্তঃপরিচর্যা

কাজুবাদাম গাছে খুব একটা আন্তঃপরিচর্যা ও সার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। তবে ভালো ফলনের জন্য প্রতি ফলন্ত গাছে গোবর ৪০ কেজি, ইউরিয়া-১ কেজি, টিএসপি-১ কেজি এবং এমপি সার ১ কেজি প্রয়োগ করা যেতে পারে। এ ছাড়া পাতা শোষক পোকা ও পাতা কাটা পোকা প্রভৃতি কাজুবাদামমের ক্ষতি সাধন করে। তাই পরিমিত পরিমাণে কীটনাশক প্রয়োগ করে কীটপতঙ্গ দমন করা যায়। আন্তঃপরিচর্যা বলতে আগাছা পরিষ্কার করা, মরা অপ্রয়োজনীয় ডাল ছাঁটাই করা বা প্রম্ননিং এবং সঙ্গী ফসল চাষ করা যেতে পারে।

ফলন ও বাদাম সংগ্রহ

চারা রোপণের পর গাছের বয়স তিন বছর হলে প্রথম ফুল এবং ফল আসে। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি ফুল ফোটার সময়। এপ্রিল থেকে জুন মাস কাজুবাদাম সংগ্রহকাল। গাছ থেকে সুস্থ ফল সংগ্রহ করে খোসা ছাড়িয়ে বাদাম সংগ্রহ করে তারপর ভালোভাবে রোদে শুকিয়ে ভেজে প্যাকেটজাত করা হয়। সাধারণত একটি গাছ থেকে ৫০-৬০ কেজি ফলন পাওয়া যায়। ১ কেজি ফল প্রক্রিয়াজাত করে তা থেকে গড়ে ২৫০ গ্রাম কাজুবাদাম পাওয়া যায়। জাতভেদে ফলনের তারতম্য হতে পারে।

প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি

কাজুবাদাম সাধারণত ভেজে খাওয়া হয়। পাহাড়ি এলাকায় সাধারণত কাজুবাদামকে দা দিয়ে কেটে খুঁচিয়ে শাঁস বের করা হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে বীজের আবরণ তুলে ফেলা হয়। লবণ-জলে কিছুক্ষণ ভিজিয়ে তারপর ভাজা হয়। এতে লবণাক্ত স্বাদের কাজুবাদাম পাওয়া যায়। আর মিষ্টি স্বাদের কাজুবাদামের জন্য বাদাম ভাজার পর চিনির শিরায় ডুবিয়ে নেওয়া হয়। বিভিন্ন খাদ্যের স্বাদ বাড়ানোর জন্যও কাজুবাদাম ব্যবহার করা হয়। কারখানায় প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি ভিন্ন এবং অপেক্ষাকৃত নিরপাদ।

কাজুবাদামের পুষ্টিগুণ

শরীরিক উপকারিতার দিক থেকে কাজুবাদামের কোনো বিকল্প হয় না। এতে উপস্থিত প্রোটিন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, খনিজ এবং ভিটামিন নানাভাবে শরীরের উপকারে লেগে থাকে। শুধু তাই নয়, কাজুবাদামে ভিটামিনের মাত্রা এত বেশি থাকে যে চিকিৎসকরা একে প্রাকৃতিক ভিটামিন ট্যাবলেট নামেও ডেকে থাকেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত যদি কাজুবাদামম খাওয়া যায়, তাহলে শরীরে নানা পুষ্টিকর উপাদানের ঘাটতি দূর হয়, সেই সঙ্গে আরও কিছু উপকার পাওয়া যায়। প্রতিদিন একমুঠো করে কাজুবাদাম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। আসলে এই বাদামটির শরীরে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট- যা ক্যান্সার সেলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। কাজুবাদামে থাকা প্রম্যান্থো সায়ানিডিন নামে একটি উপাদান এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। প্রাকৃতিক উপাদানটিতে থাকা জিঙ্ক, ভাইরাসের আক্রমণের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে। প্রতিদিন কাজুবাদাম খেলে হার্টের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কমে। এতে উপস্থিত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট একদিকে যেমন ক্যান্সার রোগকে দূরে রাখে, তেমনি নানাবিধ হার্টের রোগ থেকে বাঁচাতেও বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।

কাজুতে রয়েছে ওলিসিক নামে এক ধরনের মোনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড- যা দেহে বাজে কোলেস্টরলের মাত্রা কমাতে দারুণ কাজে আসে। তাইতো নিয়মিত এই বাদমটি খেলে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ফলে হার্টের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা হ্রাস পায়। কাজুবাদাম খেলে চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। কপার হলো সেই খনিজ, যা চুলের ঔজ্জ্বল্য বাড়ানোর পাশাপাশি চুলের গোড়াকে শক্তপোক্ত করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। আর এই উপাদানটি প্রচুর পরিমাণে রয়েছে কাজুতে। আমাদের দেশে যে হারে সুগার রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বাদাম খাওয়ার প্রয়োজন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কারণ একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রোটিন এবং ফাইবার সমৃদ্ধ এই খাবারটি নিয়মিত খেলে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আশঙ্কা কমে। সেই সঙ্গে শরীরের কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।

কাজুবাদাম চাষে সাফল্যের গল্প

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ডেইলপাড়ায় দেশের প্রথম কাজুবাদামের সমন্বিত কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন স্থানীয় উদ্যোক্তা শাকিল আহমেদ। সম্প্রতি তার এই প্রক্রিয়াজাত কারখানা পরিদর্শন করে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘খুবই ভালো উদ্যোগ। আমার খুব ভালো লেগেছে। মনপ্রাণ জুড়িয়ে গেছে। মুগ্ধ হওয়ার মতো, চমৎকৃত হওয়ার মতো উদ্যোগ। কৃষি খাতের উন্নয়নে আমার এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।’

শাকিল আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে পাহাড়ি এলাকার উৎপাদিত ৩০ টন কাজুবাদাম তিনি ভারতে রপ্তানি করেন। বাংলাদেশ থেকে সেটিই ছিল কাঁচা কাজুবাদাম রপ্তানির প্রথম চালান। এরপর ২০১৬ সালে দেশের প্রথম কাজুবাদাম প্রস্তুতকরণের সমন্বিত কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাড়ে তিন হাজার কেজি কাজুবাদাম রপ্তানির চুক্তিপত্র হয়েছে বলেও জানান এই উদ্যোক্তা।

এই বিভাগের আরও সংবাদ