স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্প-কারখানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিন

করোনা ভাইরাসের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ও জীবিকা বাঁচাতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হলেও শিল্প-কারখানা এবং ব্যবসা- প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান

ইপেপার / প্রিন্ট ইপেপার / প্রিন্ট
২৯৮

করোনা ভাইরাসের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি ও জীবিকা বাঁচাতে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত আকারে হলেও শিল্প-কারখানা এবং ব্যবসা- প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতা, অর্থনীতিবিদ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট নাগরিকরা। তারা বলেছেন, রপ্তানিমুখী শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে পর্যায়ক্রমে খুলে দেয়া হোক। তারা খাতওয়ারি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে টাস্কফোর্স গঠন করে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন।

গতকাল শনিবার রাজধানীর মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) আয়োজিত আলোচনা সভায় তারা এসব কথা বলেন। সংগঠনটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের সঞ্চালনায় ব্যবসায়ী নেতা, অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন জেলা চেম্বার নেতারা অনলাইনে যুক্ত হন আলোচনায়। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বণিক বার্তা সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ, একাত্তর টেলিভিশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও এডিটরস গিল্ডসের সভাপতি মোজাম্মেল বাবু, ডিবিসি টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মন্জুরুল ইসলামসহ সিলেট, বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রমুখ।

- Advertisement -

বক্তারা বলেন, লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকা ও দেশের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য সীমিত আকারে হলেও পর্যায়ক্রমে শিল্প-কারখানা খুলে দিতে হবে। চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়ার মতো প্রতিদ্ব›দ্বী দেশগুলো এ মুহূর্তে তাদের রপ্তানিমুখী শিল্প খুলে দেয়ার বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

সতর্কভাবে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়ে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু কিছু কলকারখানা খুলে দেয়া দরকার। এই মুহূর্তে দেশের ৫৫টি জেলা করোনা আক্রান্ত। ৪০টি জেলা লকডাউনে আছে। যেসব এলাকায় লকডাউন নেই সেসব এলাকার লোকজনকে বসিয়ে রেখে কোনো উপকার হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ আমেরিকা, কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলো কিছু কিছু শিল্প-কারখানা খুলে দিয়েছে। তা ছাড়া আমরা লকডাউনের তেমন সুফল পাচ্ছি না। আমরা বুঝতে পারছি না, আমাদের লকডাউন কতদিন চলবে এবং কত দিন পর থেকে আমরা সুবিধা পাব। সুতরাং স্বাস্থ্যবিধি মেনে কিছু কিছু কারখানা খোলা রাখা যায় কিনা তা ভেবে দেখা উচিত। আমরা যদি কাঁচাবাজার খোলা রাখতে পারি, তাহলে কেন ছোটখাটো দোকানপাট খোলার ব্যবস্থা করতে পারব না? আমাদের সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, বেনাপোল বন্দর খুলে দেয়া উচিত। কারণ রমজানের অনেক পণ্য আটকে আছে বন্দরে। যেগুলোর দাম দুয়েকদিনের মধ্যেই বেড়ে যাবে। সুতরাং এগুলো মোকাবেলা করতে হলে কিছু কিছু কারখানা খুলে দিতেই হবে, তা স্বাস্থ্যবিধি মেনে।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাত উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্তের আলোকে শিল্প-কারখানা পর্যায়ক্রমে খুলে দিতে হবে। সারা পৃথিবী ঝুঁকির মধ্যে। ঝুঁকির মধ্যেও জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশ তাদের প্রধান শিল্প খাত ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। এফবিসিসিআইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন খাত পর্যালোচনা করে আমাদেরও পদক্ষেপ নিতে হবে। এ জন্য এফবিসিসিআইকে একটি গাইডলাইন তৈরি করে সরকারকে দেয়ার অনুরোধ জানান তিনি।

গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, শিল্প ও দেশের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে লাল, হলুদ ও সবুজ রঙে চিহ্নিত করে বিভাজন করা জরুরি। সে ক্ষেত্রে এফবিসিসিআই, বিজিএমই ও অন্যান্য খাতকে সঙ্গে নিয়ে খাতভিত্তিক হেলথ প্রটোকল নির্ধারণ করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, এফবিসিসিআই অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠন মিলে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা, আইএলও এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সম্ভাব্য হেলথ প্রটোকল মেনে দেশের শিল্প-কারখানা ধীরে ধীরে খুলে দেয়ার কৌশল নিয়ে কাজ করছে সরকার। খাদ্যদ্রব্য পরিবহন ও কৃষিপণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রের প্রতিবন্ধকতা দূর করা জরুরি।

ঢাকার বাইরে পোশাক শ্রমিকদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে না আসার অনুরোধ জানিয়ে এফবিসিসিআই সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এমপি বলেন, কারখানার আশপাশের শ্রমিক দিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। যেসব শ্রমিক আসবে না, তাদের বেতন মোবাইলে চলে যাবে। এফবিসিসিআইর আরেক সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে অর্থনীতি সচল রাখতে হবে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, ৬৪ জেলায় করোনা টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। এক্ষেত্রে বেসরকারি খাত এগিয়ে আসতে পারে। এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদ বলেন, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা সবার আগে খুলে দিতে হবে। রেল ও নৌপথ ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন হলে চাপ কমবে।

মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজের (এমসিসিআই) সভাপতি বলেন, দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা যেন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ না দেই, এখন আমাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। বিজিএমইএর সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, পোশাক শিল্পের ৮৬৫টি কারখানা খুলে দেবার দাবি আছে। এ পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলারের ওপর অর্ডার বাতিল হয়েছে। আমাদের ওপর কারখানা খুলে দেবার চাপ আছে। অনেকের অর্ডার আছে। এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে, দিনক্ষণ বেঁধে, সীমিত আকারে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করে কারখানা খুলে দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য খালাসের জন্য চলতি মাসের ৩০ তারিখ পর্যন্ত জরিমানা ছাড়াই পণ্য ছাড়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার দাবি জানান চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, শিপিং এজেন্টদের অফিস দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকায় কাগজ তৈরিতে বিলম্ব হচ্ছে এবং তাতে জরিমানা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তিনি শিপিং অফিস দুপুর ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখার দাবি জানান।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা শুধু রমজান মাসে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেন। কিন্তু এবার সে সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কীভাবে তাদের ব্যবসা পর্যায়ক্রমে খুলে দেয়া যায় সে ব্যাপারে একটি নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও সংবাদ