শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সবুজ ভাইয়ের টং’ শুধু দোকান নয়, স্মৃতির আঙিনা

টিলার ওপরে চত্বরের নাম গিফারি চত্বর। আর এই চত্বরকে ঘিরেই ঘরে উঠেছে সবুজ ভাইয়ের টংদোকান। একটা টিনের ছাউনি, স্টিলের কাঠামো, কাচের একটি কাঠামোয় সাজানো শিঙাড়া-পেঁয়াজু আর পাতিলে রাখা ডিমের সঙ্গে খিচুড়ি। সঙ্গে চা আর সামান্য পানীয়। বসার চার থেকে পাঁচটি বেঞ্চ ও টেবিল। এতটুকুই হয়তো চোখে পড়ে প্রথমবার যিনি আসেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গিফারি চত্বরে। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে এটি শুধুই দোকান নয়, এটি ‘সবুজ ভাইয়ের টং’; স্মৃতির আঙিনা, সম্পর্কের উষ্ণতা, নির্ভরতা আর আবেগের নাম।হাজারো শিক্ষার্থী কিংবা ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক হওয়া সবাই তাঁকে সবুজ ভাই নামেই চেনেন। সবার সঙ্গেই তাঁর খাতির ভালো। হাসি-আনন্দে, উল্লাসে কিংবা দুঃসময়ে সবুজ ভাইয়ের পাশে থাকেন তাঁরা। ক্যাম্পাসের অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সাক্ষী তিনি।

সবুজ ভাইয়ের পুরো নাম সবুজ মিয়া। ২০০২ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ভবনের নির্মাণকাজে শ্রমিক হিসেবে কাজ করা শুরুর মধ্যে ক্যাম্পাসে বিচরণ তাঁর। পরে এলাকার এক ভাইয়ের সহযোগিতায় শুরু করেন টংদোকান। ব্যবসায় নতুন, নিয়মকানুন না জেনেই বাকিতে জিনিস বিক্রি করে লোকসান করেন প্রায় ছয় হাজার টাকা। হাল ছেড়ে দেননি। আবার দোকান দেন শিক্ষা ভবনের সামনেই। ভাগ্য তখন ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে।

 

২০১১ সালে এক আঘাত আসে, হঠাৎ করেই প্রশাসনের আদেশে দোকান বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিনি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ফুচকার দোকান দেন। পরে ইউসি বিল্ডিংয়ের সামনে টংদোকান চালান। তবে ২০১৯ সালে সমাবর্তনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্যবর্ধনের কারণে সব টংদোকান উচ্ছেদ হলে তাঁর দোকানও হারিয়ে যায়।

পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যান সবুজ মিয়া। সেই কঠিন সময়ে তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ইউসুফ নামের এক শিক্ষার্থী তাঁকে দোকান চালু করতে দেন ৭০ হাজার টাকা। আরও অনেকেই সহযোগিতার হাত বাড়ান। সব মিলিয়ে লাখ টাকার সহায়তা দিয়ে ২০২০ সালে গিফারি চত্বরের টিলার ওপরে নতুন করে শুরু হয় ‘সবুজ ভাইয়ের টং’।

তবে আবার বাধা আসে। ২০২০ সালের শুরুতে মাত্র এক মাস দোকান চালাতে না চালাতেই শুরু হয় করোনা মহামারি। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায় ১৮ মাসের জন্য। সেই দীর্ঘ সময় পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার একমাত্র ভরসা ছিল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সংগঠন ও তাঁদের ব্যক্তিগত সহায়তা।

সবুজ মিয়া বলেন, বর্তমানে মাস শেষে আয় যা থাকে, তার চেয়ে বেশি ঋণ। ক্যাম্পাস ছয় মাস খোলা থাকলে ছয় মাস বন্ধ থাকে—এমন অনিশ্চয়তায় প্রতিদিনই একরকম টিকে থাকার লড়াই। ক্যাম্পাসে পুরোদমে ক্লাস হলে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা বিক্রি হয়। লাভ থাকে দেড় হাজারের মতো। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলে আয় নেই।

সবুজ ভাইয়ের দোকানে বিক্রি হয় শিঙারা, আলুর চাপ, ডালের বড়া, বেগুনি, পেঁয়াজু। সব রান্না হয় তাঁর বাসায়। তাঁর স্ত্রী নিজ হাতে তৈরি করেন। সঙ্গে থাকে চা, ঠান্ডা পানীয় ও মাঝেমধ্যে জুস।

 

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী জুনেদ আহমেদ বলেন, ‘সবুজ ভাইয়ের টং শুধু দোকানই নয়, এটা আবেগের জায়গা। সেখানে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে কত আড্ডা, গান, গল্প জমা আছে।’

সবুজ মিয়ার পৈতৃক বাড়ি ময়মনসিংহের নান্দাইলে হলেও বেড়ে ওঠা সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুরে। পরিবারে আছেন বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে ফরহাদ মিয়া এখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ছে, ছোট ছেলে মোরাদ নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

এই ক্যাম্পাস ছাড়তে মন চায় না বলে জানালেন সবুজ মিয়া। তিনি বলেন, ২০১৪ সাল থেকে সবাই তাঁকে ‘সবুজ ভাই’ নামে চেনেন। শিক্ষার্থীরা নতুন কোনো আয়োজন করলে দাওয়াত দেন। খেলাধুলা উপলক্ষে কোনো নতুন জার্সি বানানো হলে প্রায় প্রতিটি দলই তাঁর জন্য একটি রাখে। সবাই ভালোবাসেন, আন্তরিকভাবে ডাকেন, তখন তাঁর প্রাyণ জুড়ায়।