এমন একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা নিয়ে কলামটি সূচনা করছি, যা শুনলে বা পাঠ করলে কেয়ামত দিবসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত ৮ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মাকসুদ আলম খন্দকার খোরশেদ টেলিফোনে জানতে পারেন, জামতলায় (তোলারাম কলেজের পশ্চিম পাশের এলাকা) আফতাব উদ্দিন নামে ৭০ বছরের এক মৃত ব্যক্তির লাশ পড়ে আছে; কিন্তু তাকে দাফন করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। আতঙ্কের বিষয়, পরিবারের সবাই উপস্থিত (মরহুমের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে) করোনাভাইরাসে মৃত সন্দেহে আফতাব উদ্দিনের লাশের কাছে কেউ যায়নি।
উল্লেখ্য, ফেসবুক ও পত্রিকান্তরে জানা যায়, করোনায় মৃত্যুর কারণে অনেক লাশ দাফন হচ্ছে যেখানে স্ত্রী-সন্তানরা সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসছে না। স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের সুখের জন্য মানুষ কিনা করে (!), অথচ দুঃসময়ে মানুষটি যখন লাশ হয়ে যায় তখন কেউ তার কোনো কাজে আসে না। এ ধরনের মর্মান্তিক দৃশ্য সূরা বাকারার ৬৮ নম্বর আয়াত স্মরণ করিয়ে দেয়। ওই আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা সে দিনকে ভয় করো, যে দিন কেউ কারো কোনো কাজে আসবে না এবং কারো সুপারিশ গৃহীত হবে না, কারো কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ গৃহীত হবে না এবং তারা কোনো সাহায্যও পাবে না।’ তবে কি করোনাভাইরাস কিয়ামতের কিছু নমুনা হিসেবেই পৃথিবীতে আবির্ভূত (!) হয়েছে! করোনাভাইরাস গোটা দুনিয়ার বড় বড় শক্তিকে পরাস্ত করে দিলো, অথচ ভাইরাসটি এত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যা খালি চোখে দেখা বা হাত দিয়ে অনুভব করা যায় না। বিশ্বব্যাপী সব মানুষ এখন এতই আতঙ্কগ্রস্ত যে, নিজেকে ছাড়া প্রিয়জনদের নিয়ে ভাবার মানসিকতাও যেন হারিয়ে ফেলেছে।
Ad by Valueimpression
প্রত্যেক মানুষের দৈনন্দিন কৃতকর্ম লিপিবদ্ধ করার জন্য সৃষ্টিকর্তা দু’জন ফেরেশতাকে নিয়োজিত রেখেছেন, যারা কিরামান-কাতিবিন, অর্থাৎ সম্মানিত কিতাব লেখক নামে পরিচিত। কিন্তু তারা অদৃশ্য এবং করোনার মতোই ওই ফেরেশতাদের দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না, অনুভব করা যায় না। এ মর্মে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘স্মরণ রেখো, দুইজন ফেরেশতা তার ডানে ও বামে বসে তার কাজকর্ম লিখে রাখে। মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে তা লিখে রাখার জন্য তৎপর প্রহরী তাদের কাছেই রয়েছে’ (সূরা কাফ, আয়াত : ১৭-১৮)। এবং আরো বলেছেন, ‘তার সঙ্গী ফেরেশতা বলবে, এই সেই হিসাবের কিতাব যা আমি প্রস্তুত রেখেছি’ (সূরা কাফ, আয়াত : ২৩)। ‘ওদের সব কার্যকলাপ জবুর কিতাবে আছে। ছোট-বড় সব কিছুই তাতে লেখা আছে’ (সূরা কামার, আয়াত : ৫২৫৩)। অদৃশ্য করোনাকে মানুষ যতটুকু ভয় পাচ্ছে, কিরামান-কাতিবিনের কিতাব লেখাকে বিন্দুমাত্র ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, বিষয়টিকে একটি কল্পকাহিনী মনে করে।
মানবজাতি বিশেষ করে মুসলমানরা যদি বিশ্বাস করত যে, একদিন অদৃশ্য শক্তি তার যাবতীয় কর্ম পর্যবেক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করছে, তবে নিজেরা সীমা লঙ্ঘনের প্রতিযোগিতায় জড়িত হতো না। সীমা লঙ্ঘন সম্পর্কে আল কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন যার কিছু অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে ও সত্য আসার পর তা প্রত্যাখ্যান করে, তার চেয়ে বড় সীমা লঙ্ঘনকারী আর কে এবং ওরা ওদের কর্মের ফল ভোগ করবে, আর আল্লাহর শাস্তি ব্যাহত করতে পারবে না’ (সূরা জুমার, আয়াত : ৩২-৫১)।
সীমা লঙ্ঘনকারীদের সতর্ক করে আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘আসন্ন দিন সম্পর্কে ওদেরকে সতর্ক করে দাও, যখন দুঃখে-কষ্টে ওদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। সীমা লঙ্ঘনকারীদের জন্য কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নেই, এমন কেউ সুপারিশ করার নেই, যার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে’ (সূরা মুমিন, আয়াত : ১৮)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘সীমা লঙ্ঘনকারীদের কোনো অভিভাবক নেই, কোনো সাহায্যকারীও নেই’ (সূরা শূরা, আয়াত : ৮)। ‘সেসব জনপদের অধিবাসীদের আমি ধ্বংস করেছিলাম, যখন ওরা সীমালঙ্ঘন করেছিল এবং তাদের ধ্বংসের জন্য আমি ঠিক করেছিলাম এক নির্দিষ্ট ক্ষণ’ (সূরা কাহাফ, আয়াত : ৫৯)।
মানুষ নিজ কামনা-বাসনাচরিতার্থ করার জন্যই সীমালঙ্ঘন করে, সীমাহীন বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার জন্য সীমালঙ্ঘন করে। মৃত্যুর পর সীমালঙ্ঘন করে অর্জিত সম্পদের মালিক হয় তার সন্তানরা, অথচ এই সন্তানই দুঃসময়ে তার পাশে না থাকার ইতিহাসবিরল কোনো ঘটনা নয়। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা, মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে ২৪ বছর পলাতক থেকে সাজাপ্রাপ্ত আসামি বরখাস্তকৃত ক্যাপ্টেন মাজেদ বাংলাদেশে এসেছিলেন হয়তো গোপনে তার সন্তানদের সাথে শেষ জীবনটা কাটানোর জন্য। জেল কোডের বিধান অনুযায়ী, ফাঁসির আগে নিকট আত্মীয়স্বজনের দেখার একটি সুযোগ দেয়া সত্ত্বেও (পত্রিকান্তরে প্রকাশ) তার সন্তানরা মাজেদকে শেষ দেখা দেখতে কারাগারে আসেনি। তবে এর পেছনে অন্য কোনো কারণও থাকতে পারে। তবে মোট দাগে এটাই প্রতীয়মান যে, বৈষয়িক স্বার্থ পিতা-সন্তানের সম্পর্ক মানে না। পৃথিবীতে স্বার্থটাই বড়, সে পিতা-মাতাই হোক বা সন্তানই হোক না কেন? ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলেও এ ধরনের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। যবনিকায় এ কথাই বলতে হয়, সৃষ্টিকর্তাই আপন। দুর্যোগ-দুঃসময়ে তিনি কোনো না কোনো মানবজাতিকে মুক্তি দেন, ছায়া দেন; যদি কেউ ক্ষমা চেয়ে তার কাছে আত্মসমর্পণ করে।
পরিবেশবিদদের মতে, করোনাভাইরাস পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার সুদিন এনেছে। মানবজাতির অত্যাচার-নির্যাতনে জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হচ্ছিল, তা প্রকৃতি পুষিয়ে নিচ্ছে। কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে ডলফিনের উল্লাস, কক্সবাজার সৈকত লাল কাঁকড়ার সুন্দর সমাহারসহ তরুলতার শোভাবর্র্ধন, সেন্টমার্টিন শৈবাল দ্বীপে কচ্ছপের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটানোর মনোরম দৃশ্য এখন মিডিয়াতে প্রকাশ পাচ্ছে, যা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অনেক সহায়ক বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। একদল তরুণ-তরুণী দল বেঁধে চট্টগ্রাম শহরে অভুক্ত কুকুর-বিড়ালদের রান্না করা খাবার পরিবেশন করে মানবতাবাদীদের প্রতি মনের খোরাক সৃষ্টির সুসংবাদ দিচ্ছেন। পাশাপাশি সরকারি ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করে মেম্বার, চেয়ারম্যান, সরকারি দলের নেতা, ডিলার কালোবাজারে বিক্রির দায়ে গ্রেফতার হওয়ার সংবাদ গণমানুষের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে।
ভালো-খারাপ মিলিয়েই এ পৃথিবী। তবে ভালোর চেয়ে খারাপের সংখ্যা অনেক গুণ বেশি। স্বার্থের কাছে বিবেক বারবারই চপেটাঘাত খাচ্ছে, হচ্ছে অপমানিত, অপদস্থ, লাঞ্ছিত। ছোট পরিবার, পাড়া-মহল্লা-গ্রাম থেকে শুরু করে প্রভাবশালীরা রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বার্থের সঙ্ঘাতে পৃথিবীটাকে ভারসাম্যহীন করে তুলছে, ফলে পৃথিবী হয়ে উঠেছে বসবাসের অযোগ্য।
মানুষ জাতি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনে অজ্ঞান, কিছু নাস্তিক বা বকধর্মী বুদ্ধিজীবী ছাড়া। কিন্তু স্বার্থের সঙ্ঘাতে ধর্মীয় আদর্শ বাস্তবায়ন করে না। মুসলমানদের বিশ্বাস করা অত্যাবশ্যক যে, প্রতি মানুষের প্রতিটি কর্ম, বাক্য সৃষ্টিকর্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত কিরামান-কাতিবিন (সম্মানিত লেখক) প্রতিনিয়ত লিপিবদ্ধ করছে; কিন্তু এ লিপিবদ্ধ করাকে মুসলমানরা হয় বিশ্বাস করে না, নতুবা ভয় পায় না। অথচ ভয় পাচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অদৃশ্য করোনাভাইরাসকে। বিচিত্র এই পৃথিবী, বিচিত্র মানুষের কর্ম ও কর্মজ্ঞান (!)।
বি: দ্র: কুরআন শরিফের বিভিন্ন আয়াতের বাংলা অর্থ বিচারপতি হাবিবুর রহমান রচিত কোরান সূত্র থেকে সংগৃহীত।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী