দুর্যোগ মোকাবিলায় অনলাইন শিক্ষা ও গবেষণা
প্রফেসর ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
আজ আমরা সভ্যতার ক্রমবিকাশের ফলে উত্তরাধুনিক যুগে উপনীত হয়েছি এই শিক্ষা, গবেষণা এবং প্রযুক্তির কল্যাণে। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিও আমাদের দাঁড় করিয়েছে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সারাবিশ্বের এই অসহায় অবস্থা এটাই ভাবায় যে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আরও বাস্তবমুখী এবং সময় উপযোগী করা এখন সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
শুরুতেই জেনে নেওয়া যাক অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিংয়ের বিষয়ে। একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইসে ইন্টরনেটের মাধ্যমে যে কোনো স্থান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার প্রক্রিয়াকে ই-লার্নিং বলা হয়ে থাকে। ই-লার্নিংয়ের ৮০ শতাংশের বেশি পাঠ কার্যক্রম ইন্টারনেট নির্ভর। তাই একে ডিসট্যান্স লার্নিংও বলা হয়। এতে গতানুগতিক ধারায় শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত থেকে পাঠদান কিংবা পাঠগ্রহণ করতে হয় না। ই-লার্নিংয়ের বেশকিছু ভালো দিক আছে। প্রথমত, এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীরা যে কোনো স্থান থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাকে কষ্ট করে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে আসতে হয় না। দ্বিতীয়ত, যারা চাকরির পাশাপাশি লেখাপড়া করতে চান তাদের জন্য সুবিধা হচ্ছে তারা যে কোনো সময় শিক্ষামূলক ভিডিওগুলো দেখে নিজের সুবিধামত সময়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া কোনো টপিক বুঝতে সমস্যা হলে বারবার শুনে বুঝে নেওয়ার সুযোগ থাকে। মানুষ নানাভাবে খুব সহজেই শিক্ষা লাভ করতে পারে।
করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কারণে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর যে বিরুপ প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে আসা যাক। করোনা ভাইরাসের আগ্রাসনে সমগ্র পৃথিবী এখন যেন স্থির হয়ে আছে। একটা যুদ্ধাবস্থা দেশে দেশে। থমকে গেছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল, কলেজ এবং অন্যান্য সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ১৩০টি দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের দেশেও আগামী ৯ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছুটি আরো বাড়তে পারে। যার ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। এদিকে এই অচল অবস্থা বিরাজ করছে মাসের পর মাস পৃথিবী ব্যাপী। শিক্ষার্থীরা শিক্ষা নিতে পারছে না। আর শিক্ষক পারছে না শিক্ষা প্রদান করতে। জীবন তো আর থামিয়ে রাখা যায় না। ঠিক সেভাবেই শিক্ষা কাযর্ক্রমও থেমে থাকা উচিত নয়।
যেহেতু সবাই বাড়িতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে সেক্ষেত্রে বাড়িতে বসেও শিক্ষা কাযর্ক্রম অব্যহত রাখা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশেও স্বল্প ব্যাপ্তিতে অনলাইনে শিক্ষা প্রদান কমর্সূচি চলছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ‘জুম অ্যাপ্লিকেশন’ ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান কাযর্ক্রম অব্যাহত রাখতে পারবে। এক্ষেত্রে বিডিরেন (বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন নেটওয়ার্ক) সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করবে। এই প্রযুক্তিতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের ক্লাস লেকচারের পাশাপাশি ক্লাসে অংশগ্রহন করতে পারছে এবং নিজের মতামতও প্রকাশ করতে পারছে।
বাংলাদেশে ই-লার্নিংয়ের চর্চা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শুরু হয়নি এখনো। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের ফলে সৃষ্ট পরিস্থতির কারণে সংশ্লিষ্ট বোদ্ধাগণ ই-লার্নিয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করা হচ্ছে যার বেশিরভাগই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখনও এ ধরনের কার্যক্রম দেখা যাচ্ছে না।
বর্তমানে প্রায় সব ইউনিভার্সিটির নিজস্ব ওয়েব সাইট আছে। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লেখাপড়ায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাবহারে এগিয়ে। তাই তাদের পক্ষে ই-লার্নিংয়ের ব্যবস্থা করা কঠিন নয়। অনেক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় জুম অ্যাপ্লিকেশন, মাইক্রোসফট, গুগল ক্লাসরুম ব্যবহার করে অনলাইনে পাঠদান করছে।
আর যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ধরনের সুবিধা নেই, তারা সহজেই আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে দিতে পারে।
বাংলাদেশে অনলাইনভিত্তিক লেখাপড়ার ব্যবস্থা করলে অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। ফলে তাদের পরিবার পরিজন ছেড়ে দূরে গিয়ে হাজার প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে লেখাপড়া করতে হবে না।
চীনের উহানে যখন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমাতে লকডাউন পরিস্থতি বিরাজ করছিল, তখন উহানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় বাড়িতেই ক্লাস নেওয়া হচ্ছিল। শিক্ষার্থীরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিক্ষকের সঙ্গে সংযুক্ত থেকে শিক্ষা কাযর্ক্রম অব্যহত রাখতে পেরেছে। করোনা ভাইরাসের প্রাদূর্ভাবকালীন সময়ে চীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। চীনের ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় দুসপ্তাহের মধ্যেই পাচঁ হাজারেরও বেশি কোর্স অনলাইনভিত্তিক করে ফেলতে সক্ষম হয়।
ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যারয় তাদের সব শিক্ষার্থীকে এই ই-লার্নিং পদ্ধতির আওতায় নিয়ে আসে। বিদেশি শিক্ষার্থীরাও এই সুযোগ লাভ করে, এমনকি কিছু কোর্স বিশ্বব্যাপী সব শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি একটি কোর্স হাবের ব্যবস্থা করে যা পাঁচ লাখ সত্তুর হাজার মানুষকে আকৃষ্ট করে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি ই-কমার্স কোম্পানি আলিবাবার সাথে যুক্ত হয়ে একটি ‘Ding Talk ZJU’ নামক একটি অ্যাপ তৈরি করে যা প্রায় ৩ লক্ষ মানুষকে আকৃষ্ট করে। সমস্যা তবুও থেকেই যায়, কারণ অনেক শিক্ষকই প্রযুক্তির ব্যবহারে দক্ষ নয়। আর তাই ZJU ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে ৩৬৭০ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণে ব্যবস্থা করে। শুধু তাই নয়, প্রায় এক হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীকে এই ডিসটেন্স এডুকেশনের অন্তর্ভূক্ত করার লক্ষে বিনিয়োগ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে চুক্তি ভিত্তিতে কম খরচে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টরনেট সেবা প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। সাথে শিক্ষার্থীরা প্লে ব্যাক এবং কোর্স ওয়্যার প্যাকেজ পাচ্ছে যার মাধ্যমে কোন লেকচার ফলো না করতে পারলেও পরবর্তীতে সহযোগীতা পেতে পারে। ZJU তাদের অনলাইন শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল স্মার্ট ক্যম্পাস তৈরির মাধ্যমে। ২০১৭ সালে তাদের অনলাইনে পাঠদানের প্রকল্প নিয়ে কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালে ZJU নতুন প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা আরও বৃহৎ পরিসরে করতে শুরু করে। সম্প্রতি ২০০ স্মার্ট ক্লাসরুমের ব্যবস্থা তারা করেছে যেখানে সহজেই শিক্ষকের ক্লাসরুমের পাঠদানের ভিডিও ধারণ এবং সরাসরি অনলাইনে প্রদশর্নের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
অনলাইন শিক্ষার মতই গবেষণামূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আজ পৃথিবীর অনেক রহস্যই আমাদের জানা শুধুমাত্র কিছু নিবেদিতপ্রাণ গবেষকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং মেধার কারণেই। তথ্য প্রযুক্তিতে যেমন মানুষ উৎকর্ষ লাভ করেছে তেমনি চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এনেছে আমূল পরিবর্তন। এখন আর কলেরা বা ফ্লুতে মানুষ ওই মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় না যতটা কয়েক শত বছর আগে দেখা যেত। ১৯১৮ সালে স্পানিশ ফ্লুতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি না জানা থাকার কারণে (তখনও পেনিসিলিন আবিষ্কার হয়নি)। হ্যাঁ, এটা সত্য যে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে কিন্তু তা আধুনিক যুগের অন্যান্য উন্নতির তুলনায় অপ্রতুল। এই বিষয়টিই আমরা এখন উপলব্ধি করছি করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার মাধ্যমে। বিগত ডিসেম্বর হতে আজ পর্যন্ত কোন প্রতিষেধকের কথা সব দেশের নামিদামী গবেষক মিলেও পরিষ্কার করে কোনো প্রতিষেধকের কথা বলতে পারছে না। অথচ এখন স্বয়ংক্রিও পদ্ধতিতে বহু ক্ষেত্রে কাজ চলছে, মানুষ রোবটিক্সের মতো বিষয় নিয়ে কাজ করছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের খবর শুধু নয়, মহাকাশের খবরও জানা সম্ভব হচ্ছে। এত উন্নতি দেখার পর যখন কোনো রোগে একের পর এক মানুষ মরছে কিন্তু এত উন্নত প্রযুক্তি থাকার পরও মানুষকে নিজের ইমিউনিটির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে, তখন বলতেই হয় যে চিকিৎসা ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাব রয়েছে। এই গবেষণার বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষাব্যবস্থায়।
বাংলাদেশের কথা বললে বলতে হয় যে, এদেশে মানুষ চাকরির জন্য লেখাপড়া করতে থাকে। অনেকের লক্ষ্য থাকে সরকারি চাকরির, যা পেয়ে গেলে মনে করে সোনার হরিণ পাওয়া হয়ে গেছে। তা না হলে বেসরকারি একটা ৯টা-৫টার চাকরি পেয়ে গেলেই সফল হয়ে যায়। সুতরাং গবেষণামূলক কর্মকাণ্ডে খুব কম মানুষকেই দেখা যায়।
গবেষণামূলক কাজে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এক্ষেত্রে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। এখনও যদি এক্ষেত্রে কাজ না করা হয় তাহলে ঐদিন দূর নয় যখন ভবিষ্যতে কোন উন্নয়নমূলক কাজে দেশের মেধা আর কাজে লাগানো সম্ভব হবে না। সব সময়ই উন্নত দেশগুলোর ওপর নির্ভর করেই চলতে হবে। এতে দেশের অর্থেরও অপচয় হবে। বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থতির মতো আরও বহু জটিল পরিস্থতি মোকাবেলা করতে আমরা হিমসিম খাব।
বাংলাদেশ প্রযুক্তি খাতে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। তবে যেদিন এ দেশের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন আবিষ্কার নিয়ে আসবে কেবল সেদিনই প্রযুক্তির দিক থেকে সত্যিকারের উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব হবে। তবুও আশার কথা হচ্ছে এখন এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশের কিছু মেধাবীরা ভেন্টিলেটার তৈরি এবং করোনা ভাইরাসের শনাক্তকরণ টেষ্ট কিটও তৈরিতে আশার আলো ছড়াচ্ছে। এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই এবং ভবিষ্যতে আরও এমন উদ্যোগ নেওয়া হবে এটাই আশা করি।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক যে কোন সময় যে কোন স্থান থেকে শিক্ষা কাযর্ক্রমে অংশ নিতে পারছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিতে শিক্ষা কাযর্ক্রম চালানোর লক্ষ্যে প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার। ঠিক যেভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক শিক্ষাকাযর্ক্রমে গুরুত্বসহকারে অংশগ্রহণ করে থাকে, একইভাবে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও গুরুত্বসহকারে কাজ করা প্রয়োজন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের অঙ্গীকার হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে উচ্চশিক্ষা কার্যক্রম এবং প্রায়োগিক ও উদ্ভাবনী গবেষণায় আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা।
লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন